বিদ্যুৎ সংকট মোকাবেলায় কঠোর পদক্ষেপ, বিশেষজ্ঞদের সাধুবাদ
স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় :
২৪-১১-২০২৪ ০৫:৪২:২৭ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
২৪-১১-২০২৪ ০৭:০৮:০৭ অপরাহ্ন
প্রকৌশলী আবদুল্লাহ নোমান, প্রকৌশলী জাকিউল ইসলাম ও প্রকৌশলী মোহা. শামছুল আলম
বিদ্যুৎ সংকট মোকাবেলায় কঠোর অবস্থান নিয়েছে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। ভবিষ্যতে বিদ্যুৎখাতে যাতে কোন ধরনের সংকট তৈরি না হয় সেই জন্য হার্ডলাইনে গেল সরকার। বিদ্যুৎ খাত নিয়ে নড়েচড়ে বসেছেন বিদ্যুৎ বিভাগও। এজন্য প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে বিদ্যুৎ বিভাগে আমুল পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বিদ্যুৎ প্রকল্পের উপর আসছে নতুন নির্দেশনা।
৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত নতুন সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় যেসব চ্যালেঞ্জ ছিলো তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিদ্যুৎ বিভাগ। সম্প্রতি ভারতের আদানি বিদ্যুৎ কোম্পানির সঙ্গে পতিত সরকারের করা চুক্তি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়েছে। এতে বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এই জন্য বিদ্যুৎ বিভাগকে ঢেলে সাজানোর সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বতী সরকার। দেওয়া হয়েছে নতুন নির্দেশনা।
ভবিষ্যতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রে জ্বালানি সরবরাহের শর্তহীন নিশ্চয়তা ছাড়া কোন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের প্রকল্প গ্রহণ করা যাবে না বলে নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিভাগের সংশ্লিষ্টতাও রাখা যাবে না। সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগের উপসচিব ফারজানা খানম স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তি থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
গত রোববার (১৭ নভেম্বর) বিদ্যুৎ বিভাগের এক বিজ্ঞপ্তিতে (স্মারক নং-২৭.০০.০০০০.০৮৯.২৭.০১৬.২৩.৩২২) বলা হয়, সম্প্রতি বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়ে দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে বিদ্যুৎ বিভাগ কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ প্রদান করা হয়। সার্বিক বিষয়াদি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার নিকট উপস্থাপন করা হলে তিনি বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন সকল উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ সংস্থা/কোম্পানিসমূহকে তিনটি নির্দেশনা প্রদান করেছেন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ভবিষ্যতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রে জ্বালানি সরবরাহের শর্তহীন নিশ্চয়তা ও যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই ও সমীক্ষণ ছাড়া কোন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের প্রকল্প গ্রহণ করা যাবে না। কোনো ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রকল্প পরিচালক কর্তৃক চাকরির আচরণবিধি পরিপন্থী রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সাথে দাপ্তরিক প্রয়োজন ব্যতীত সম্পর্ক রাখা যাবে না। ভবিষ্যতে কোন বিদ্যুৎ উৎপাদন বিলাসবহুল এক্সিকিউটিভ গেস্ট হাউজ, ভিভিআইপি রেস্ট হাউজ ও ক্যান্টিন নির্মাণ প্রকল্প প্রনয়ণের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সাশ্রয়ের বিষয়টি বিবেচনা করার কথাও বলা হয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সংশ্লিষ্ট সকলকে এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে বলেছেন।
বিদ্যুৎ বিতরণী কোম্পানিগুলোর প্রধানরা সরকারের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি)’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আবদুল্লাহ নোমান বাংলাস্কুপকে বলেন, বিগত সরকার জ্বালানি সরবরাহের শর্তহীন নিশ্চয়তা ও যথাযথ সম্ভাব্যতা ছাড়াই বিভিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের প্রকল্প গ্রহণ করেছে, যা রাষ্টের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান অন্তর্বতীকালীন সরকারের উপদেষ্টা মহোদয়ের এমন উদ্যোগ রাষ্ট্রের জন্য অবশ্যই সুফল বয়ে আনবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিলাসবহুল রেস্ট হাউজ নির্মাণ রাষ্ট্রের জন্য অর্থ অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। আমরা কয়দিনই বা এই রেস্ট হাউজগুলো ব্যবহার করি। বিদ্যুৎ উপদেষ্টার এমন উদ্যোগ যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ সাশ্রয় হবে।
নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই পিএলসি (নেসকো)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী জাকিউল ইসলাম বাংলাস্কুপকে বলেন, বর্তমান অন্তর্বতীকালীন সরকার অর্থ সাশ্রয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। তার মধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগেও যে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এটা নি:সন্দেহে বিদ্যুৎ খাতকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়ক হবে। এক্ষেত্রে জ্বালানি উপদেষ্টা মহোদয়কে সাধুবাদ দেয়া প্রয়োজন। তিনি স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে পরিবেশবান্ধব রিনিউবেল এনার্জির মাধ্যমে বিদ্যুতের উৎপাদনের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দরপত্র আহবানের পদ্ধতি গ্রহণের বিষয়টি বিবেচনায় এনেছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী এবং প্রতিষ্ঠানের সাথে ইতিমধ্যে সভা করে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, জ্বালানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করে নেসকোর আওতাধীন রাজশাহী এবং রংপুর এলাকায় লো ভোল্টেজ সমস্যা নিরসনে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিবেচনায় আনা যেতে পারে বলে প্রকৌশলী জাকিউল ইসলাম মনে করেন।
ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতি. দা.) প্রকৌশলী মোহা. শামছুল আলম বাংলাস্কুপকে বলেন, বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মহোদয় একটা যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নতুন প্রকল্প হলে অবশ্যই জ্বালানির নিশ্চয়তা থাকতে হবে। দেশের অর্থ সাশ্রয় করতে হবে, পাশাপাশি নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পও গ্রহণ করতে হবে। বিদ্যুৎ উপদেষ্টা যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন তা এই খাতকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। দেশে আর কোন বিদ্যুৎ সংকট থাকবে না।
এ ব্যাপারে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন বলেন, এর আগে আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তি নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের অবস্থান ছিল অস্পষ্ট। চুক্তিটি যে দেশের স্বার্থবিরোধী, সেটিই এখন প্রকাশ পাচ্ছে। তাই সামনে যাতে কোন ধরনের সমস্যা, সংকট তৈরি না হয় সেইজন্য যদি সরকার কোন উদ্যোগ নেন তাহলে সাধুবাদ। নতুন করা নির্দেশনা যদি যুগোপযোগী হয় সেটা ভালো সিদ্ধান্ত। তবে সবকিছুর বাস্তবায়নই হলো আসল সফলতা।
এদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ বাতিলে অধ্যাদেশের খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। গত বুধবার (২০ নভেম্বর) সচিবালয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার কক্ষে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়।
সভা শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ এর ধারা-৬ এর অধীন বিদ্যুৎ উৎপাদন চুক্তি সম্পাদন বিষয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা বিষয়ে জনমনে প্রবল বিরূপ ধারণা তৈরি হয়েছে এবং গত ১৪ নভেম্বর বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ এর ধারা ৬(২) ও ধারা ৯ মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ রিট পিটিশন নং ১০৩৭৮/২০২৪ এর আদেশ দ্বারা অবৈধ ঘোষণা করেছে।
এ ব্যাপারে গত শুক্রবার (২২ নভেম্বর) বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গণমাধ্যমকে বলেন, গত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় ২০১০ সালের দ্রুত বিদুৎ ও জ্বালানি সংগ্রহের আইনটি পুরোপুরি বাতিল করা হয়েছে। এটা সংস্কারেই অংশ। এছাড়াও আদানির সঙ্গে চুক্তির বিষয়টি পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বাংলা স্কুপ/বিশেষ প্রতিবেদক/এনআইএন/এসকে
প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স